প্রান্তজনের কণ্ঠস্বর: বাংলাদেশে করোনার অভিজ্ঞতা

Voices from the Margins: Covid-19 Experiences in Bangladesh

মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের হয়ে পাশে দাঁড়াও

April 3rd 2022

...

টিসিবির ট্রাকের পণ্য আনতে গিয়েই মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় দুই মেয়ের। তাঁরাও টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছেন।

প্রদীপের নিচে অন্ধকার। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোসহ সব পত্রিকায় দেশের বৃহত্তম পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি ছাপা হয়েছে। এই কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার পূরণ করেছে সরকার। খুবই আনন্দের খবর। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ নেওয়ার ক্ষমতা কি সব মানুষের আছে? নেই।

প্রথম পাতায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের খবরের পাশে আরও দুটি খবর ছাপা হয়েছে। একটি হলো ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) জরিপ। এতে বলা হয়, ৪৩ শতাংশ মানুষ খাবারের ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। বাজার স্বাভাবিক থাকলে খাবারে ব্যয় যতটুকু কমানো হয়, ততটুকু কম খাবার গ্রহণ করে ভোক্তা। আর খাবারের দাম বেড়ে গেলে তাকে আরও কম খাবার কিনতে হয়। করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে বলে খাবারে ব্যয়ও কমাতে হয়েছে। সিপিজের জরিপ অনুযায়ী, গত বছর জুনের চেয়ে ডিসেম্বরে মানুষের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও করোনার আগের অবস্থায় আসেনি। ৩৪ শতাংশ মানুষকে চলতে হয়েছে ঋণ নিয়ে, ঋণের টাকার ৩২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে খাবার কেনায়, সঞ্চয় ভেঙেছে ২৬ শতাংশ মানুষ।

তৃতীয় খবরটি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের সামনে খাদ্যপণ্যের জন্য দাঁড়ানো এক মা ও তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে। উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম স্থানীয় খেলার মাঠে অপেক্ষা করছিলেন টিসিবির কম দামে দেওয়া খাদ্যপণ্যের জন্য। তাঁর দুই মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন ও লিপা আক্তারের আলাদা আলাদা সংসার। থাকেন কাছাকাছি কোনো এলাকায়। টিসিবির ট্রাকের পণ্য আনতে গিয়েই মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় দুই মেয়ের। তাঁরাও টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছেন। দুই মেয়ের কোলে দুই শিশুসন্তান।

পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান কিংবা পার্বণে পরিবারের সদস্যদের একত্র হওয়ার রেওয়াজ আছে বাঙালি সমাজে। কিন্তু এই মা ও দুই মেয়েকে একত্র করেছে টিসিবির ট্রাক। যে অর্থ তাঁরা আয় করেন, তা দিয়ে বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারেন না বলেই টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছেন। ওই মা ও তাঁর দুই মেয়ের ভাগ্য ভালো তাঁরা তিনজনই খাদ্যপণ্য নিয়ে ঘরে যেতে পেরেছেন। কিন্তু অনেককে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে।

টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য না পেয়ে ২০ থেকে ২৫ জন নারী-পুরুষ ফিরে গেছেন। বিক্রি শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। একটি মাঠে ট্রাকের সামনে থেকে ২০ থেকে ২৫ জন খালি হাতে ফিরে গেলে টিসিবির ১৫০টি ট্রাক থেকে খালি হাতে কতজন ফিরেছেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়।

মার্চের গরমকে ছাড়িয়ে গেছে বাজারের গরম। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, ভোজ্যতেলসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আমদানিকারকেরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে বলে দেশের বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পবিত্র রমজান মাসে (এপ্রিল) বাজার পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে। ভোজ্যতেল, চিনিসহ কয়েক ধরনের পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমানো হলেও বাজারে তেমন প্রভাব পড়েনি। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। এই অবরোধ উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

যেসব পণ্য দেশে উৎপন্ন হয়, সেসব পণ্যের দামও বাড়ছে। ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। গত বছর সরকারি গুদামে চালের মজুত কম ছিল, এ সুযোগে একশ্রেণির আড়তদার ও মিলমালিক চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার শুল্ক কমিয়ে প্রচুর চাল আমদানির ব্যবস্থা করে। ভারতে চালের দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, চাল আমদানি বন্ধ রাখায় কৃষকেরা লাভবান হননি। তাঁরা আগেই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। লাভবান হয়েছেন আড়তদার ও মিলমালিকেরা। সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষকদের কাছে থেকে চাল ও ধান সংগ্রহ করলে মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফা করতে পারতেন না। কৃষকেরাও লাভবান হতেন। সরকারের বাজার তদারকি ইঁদুর-বিড়াল খেলায় পরিণত হয়েছে।

বাজারের ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এক কোটি মানুষের কাছে কম দামে পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারা দেশে বিতরণ করা কার্ডের বিপরীতে টিসিবির প্রথম দফার পণ্য পাচ্ছে মানুষ। তবে বরাদ্দ অনুসারে কম কার্ড বিতরণ, দেরিতে টিসিবির ট্রাক আসা, মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে দৌড়ানো, কার্ড নিয়েও পণ্য না পেয়ে অনেকের খালি হাতে ফেরত যাওয়া—এমন সব ভোগান্তির চিত্র অনেক জেলাতেই দেখা যায়। এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তির কাছে এবং অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারকে কার্ড বিতরণেরও অভিযোগও আছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, করোনাকালে আয় কমা ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে ছয় থেকে সাত কোটি নিম্নবিত্ত এখন কষ্টে রয়েছে। এ কারণে আরও মানুষকে সহায়তার আওতায় আনতে কার্ডের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

বাজারে অনিয়ম রুখতে নজরদারি বাড়ানো ও অভিযান চালানো, কিছু পণ্যে ভ্যাট কমানোসহ সরকারের কিছু সিদ্ধান্তে বাজারে স্বস্তি ফেরা শুরু করেছে। তবে সামনের রমজান মাসকে ঘিরে এখনো আশঙ্কামুক্ত হতে পারছে না ভোক্তারা। এ কারণে অসাধু ব্যবসায়ীদের মজুতদারি বন্ধ করতে কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য বিক্রয় সফল করতেই হবে। ভোগান্তি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তৎপর না হলে ভোক্তারা কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হবে। এর আগে করোনাকালের সহায়তাসহ নানা ত্রাণ কার্যক্রম সঠিক তদারকির অভাবে ও অনিয়মের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আবারও তেমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আমরা দেখতে চাই না।

করোনাকালে যখন সাধারণ মানুষ কাজ হারিয়েছে, যাদের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের জন্য দেওয়া সরকারের যৎসামান্য আর্থিক সহায়তাও ঠিকমতো পৌঁছানো যায়নি চুরিচামারি ও স্বজনপ্রীতির কারণে। অনেক জনপ্রতিনিধি বামালসহ ধরাও পড়েছেন। দেশ যখন করোনার প্রকোপ থেকে অনেকটা মুক্ত, তখনই বাজারের আগুন জনগণ তথা সীমিত আয়ের মানুষকে মহাদুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যে সিন্ডিকেট বরাবর বাজার কারসাজি করে, মন্ত্রীর সদুপদেশ ও মৌখিক হুঁশিয়ারি তাদের বশে আনতে পারবে না। এ জন্য বাজার তদারকের কাজটি জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন, গুজব ছড়িয়ে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তত দৃষ্টান্তমূলক হলেও দু-চারজনকে শাস্তি দিন।

আওয়ামী লীগের যে নেতারা কথায় কথায় বিএনপিকে তুলাধোনা করেন, তাদের শাসনামলের বিভিন্ন অনাচার নিয়ে কথা বলেন, তাঁরা যদি একটু নিজের দলের দিকে নজর দিতেন, সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেত।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। অনেকে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিল। গত অক্টোবরে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হলে শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এর ওপর ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো যত সহজে ধাক্কা সামলাতে পারবে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। তাই এ মুহূর্তে সরকারের উচিত দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষকে আরও সহায়তা দেওয়া। যেকোনো মূল্যে বাজার স্থিতিশীল রাখা। তবে হতদরিদ্র মানুষকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের প্রতি সমাজের সচ্ছল ও বিত্তবান মানুষের দায় আছে। তাদের সংখ্যা হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখুন। প্রকৃত উন্নয়ন মানে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া; কাউকে পেছনে ফেলা নয়।

গত রোববার রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরের বেলতলা এলাকার ৯ নম্বর বস্তিতে লাগা আগুনে দুই শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। বস্তিবাসী জানান, কেউ মারা না গেলেও তাঁদের সহায়সম্পদ সব আগুনে পুড়ে গেছে। কিছুদিন পরপর ঢাকার বস্তিতে আগুন লাগা নিয়মে পরিণত হয়েছে। যাঁরা বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরাই আগুন লাগান বলে অভিযোগ আছে। আগুন লাগলে তাঁরা নতুন করে ঘর তৈরি করে নতুন মানুষকে ভাড়া দিতে পারবেন। আবার প্রভাবশালীদের দ্বন্দ্বের কারণেও বস্তিতে আগুন লাগানো হয়। এতে প্রভাবশালীরা লাভবান হলেও সর্বস্বান্ত হয় গরিব মানুষগুলো; নতুন ঘর না ওঠা পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচেই তাদের বাস করতে হবে। প্রতিটি স্তরে আমাদের জনপ্রতিনিধি আছেন, এই নিঃসম্বল ও অসহায় মানুষের আহাজারি তাঁদের কানে পৌঁছায় না।

টিসিবির গাড়ির লাইনে দাঁড়ানো ও আগুনে পোড়া বস্তির মানুষকে দেখে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ছে।

মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও।
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও,
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে,
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে।
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও,
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও,
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।

ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনীতিকদের কাছে সবিনয়ে আবেদন করতে চাই, রাজনীতি নিয়ে বাহাস করার অনেক সময় পাবেন। এখন এই দুঃখতাড়িত ও অভাবপীড়িত মানুষের জন্য কিছু করুন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি