করোনা মহামারিতে আর্থিক সংকটের মধ্যে টিকে থাকতে ঋণ নিয়েছেন ৬৬ ভাগ মানুষ। তবে ধীরে ধীরে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমেছে। জুনে ৬৬ শতাংশ থাকলেও সেপ্টেম্বরে ৪৯ শতাংশ ও ডিসেম্বরে তা ৩৪ শতাংশে নেমে আসে। ঋণের টাকার এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যপণ্য কেনাকাটায়, এক-চতুর্থাংশ আগের ঋণ পরিশোধে এবং কিছু অংশ ওষুধ কেনা ও চিকিৎসার খরচ চালানোর কাজে ব্যয় করে মানুষ।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ (সিপিজে)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করা হয় এবং গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয়। গবেষণার তথ্যগুলো তুলে ধরেন মৃন্ময় সমদ্দার, সিনিয়র গবেষক, সিপিজে এবং সহযোগী গবেষক নাহিদা আক্তার ও হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম।
ঋণের বিষয়ে সিপিজের গবেষণা সহযোগী নাহিদা আক্তার বলেন, ঋণ নেওয়ার হার কমেছে-এর অর্থ এই নয় যে ওই ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেছে। অনেকে আগের ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই নতুন করে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন। কাজের অভিজ্ঞতার তথ্য তুলে ধরে বলেন, রাজধানীর এক বয়স্ক বস্তিবাসী নারী তাকে জানিয়েছিলেন, দুই মেয়ে পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করেন। মেয়েদের বেতন না বাড়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। দুই বেলা খাবার খান। একজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ২০০ টাকা বাকি আছে। সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভোগেন তিনি।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশের ২০টি জেলার ৪০টি উপজেলার (সব বিভাগ কাভার করা হয়েছে) ১৫৩৩টি খানা জরিপের মাধ্যমে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। জরিপকাজ চালানো হয় ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে প্রান্তিক জনপদে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। অনলাইনে পাঠদানের নির্দেশনা থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ে ডিভাইস ও ডেটার সংকট ছিল, ছিল ইন্টারনেটের ধীরগতি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষায় কাঠামোগত দক্ষতা ছিল না। শিক্ষকরা সময়মতো অনলাইন পাঠদানে প্রশিক্ষণ পাননি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ৯৬ শতাংশ মানুষ। ৩৫ শতাংশ ইনমনিয়ায় ভুগেছেন। আর কাজে মনোযোগে ঘাটতি ছিল ২২ শতাংশ মানুষের। এর মূল কারণ হিসাবে প্রতিবেদনে অপ্রতুল আয় ও খাদ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। ৬৩ শতাংশ মানুষ কোনো সরকারি সাপোর্ট বা ত্রাণ পায়নি। ৫৫ শতাংশ পরিবার আছে, যেখানে অন্তত একজন মানুষ টিকা পাননি। প্রতিবন্ধীদের টিকা নিতে যাতায়াতও ছিল বড় চ্যালেঞ্জের।
অনুষ্ঠানে আইইডিসিআর-এর প্রধান পরামর্শক অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিদের জন্য করণীয় অনেক কিছু আছে। সিপিজের এই গবেষণালব্ধ তথ্য তাদের জন্য নীতি প্রণয়নে সাহায্য করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দেবাশীষ কুন্ডু বলেন, বস্তির বাইরে শহরে অন্যান্য যে দরিদ্র মানুষ আছে তাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীতে পারিবারিক সহিংসতার প্রভাব আরও নিবিড়ভাবে লক্ষ করতে হবে। সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য এসব রিসার্চ উন্মুক্ত করতে হবে।