প্রান্তজনের কণ্ঠস্বর: বাংলাদেশে করোনার অভিজ্ঞতা

Voices from the Margins: Covid-19 Experiences in Bangladesh

মহামারির ধকল সামলাতে প্রান্তিকের হুমকি মূল্যস্ফীতি: গবেষণা

April 3rd 2022

...

করোনার থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উত্তরণের পথে ‘প্রধান হুমকি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি।

করোনা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশ আয় এখনও কম প্রান্তিক জনগোষ্ঠির। পাহাড়ি ও সমতলের আদিবাসীরা সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে করোনাকালে। সঞ্চয়ের প্রায় সবটুকু শেষ করে ফেলা এই জনগোষ্ঠী এখন ভুগছেন খাদ্যাভাবে, কোথাও শিক্ষা সঙ্কটও তীব্র হয়েছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস' এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উপরের এই চিত্র উঠে এসেছে। সোমবার এই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করা হয় এবং গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয়। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যগুলো তুলে ধরেন মৃন্ময় সমদ্দার, সিনিয়র গবেষক, সিপিজে এবং সহযোগী গবেষক নাহিদা আক্তার ও হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম। পলিসি ক্লিনিকে শিক্ষাবিদ, গবেষক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, আমলা, অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব প্রদানকারীসহ বিভিন্ন অংশগ্রহণকারীরা পারস্পরিক মতবিনিময় ও আলোচনা করেন এবং নীতিনির্ধারনী পর্যায়ের অসামঞ্জস্যতাগুলো চিহ্নিত করেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে প্রান্তিক জনপদে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত।

অনলাইনে পাঠদানের নির্দেশনা থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ে ডিভাইস ও ডেটার সঙ্কট ছিল, ছিল ইন্টারনেটের ধীরগতি।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষায় কাঠামোগত দক্ষতা ছিল না। শিক্ষকরা সময়মত অনলাইন পাঠদানে প্রশিক্ষণ পাননি। 

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাহাড়ে যাদের বসবাস, সেই পরিবারের সন্তানরা করোনা মহামারির পরও ঠিকভাবে ক্লাসে যাচ্ছে না। কারণ তাদের যাতায়াতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা লাগে এবং প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পথেই ব্যয় হয়। 

এ কারণে তারা ক্লাসে যায় না, শুধু পরীক্ষা দিতে প্রতিষ্ঠানে যায়। করোনাকালের দুই বছরে বান্দরবান জেলায় ডিগ্রি স্তরে সহায়ক বই, রেফারেন্স বইসহ কোনো শিক্ষা উপকরণ যায়নি।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ৯৬ শতাংশ মানুষ। ৩৫ শতাংশ ইনমনিয়ায় ভুগেছেন। আর কাজে মনোযোগে ঘাটতি ছিল ২২ শতাংশ মানুষের।

এর মূল কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে অপ্রতুল আয় ও খাদ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। ৬৩ শতাংশ মানুষ কোনো সরকারি সাপোর্ট বা ত্রাণ পায়নি। ৫৫ শতাংশ পরিবার আছে, যেখানে অন্তত একজন মানুষ টিকা পাননি। প্রতিবন্ধীদের টিকা নিতে যাতায়াতও ছিল বড় চ্যালেঞ্জের। 

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশের ২০টি জেলার ৪০টি উপজেলার (সব বিভাগ কাভার করা হয়েছে) ১৫৩৩টি খানা জরিপের মাধ্যমে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে। জরিপকাজ চালানো হয় ২০২১ সালের জুন থেবে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠি, পাহাড়ি, শহুরে বস্তিবাসী, নারী প্রধান পরিবার, ও যেসব পরিবারে প্রতিবন্ধী সদস্য রয়েছেন তাদর উপরে জরিপকাজ চালানো হয়। প্রতিটি খানা জরিপ পরিবারের মাঝে পৃথক তিন সময়ে তিন দফা জরিপ চালানো হয়। গবেষক দলে ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস' এর সিনিয়র গবেষক মৃন্ময় সরকার, সহযোগি গবেষক মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম ও সহযোগি গবেষক নাহিদা আখতার।

অনুষ্ঠানে আইইডিসিআর-এর প্রধান পরামর্শক অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংক্রামকব্যাধিতে আক্রান্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিদের জন্য করণীয় অনেক কিছু আছে। সিপিজের এই গবেষণালব্ধ তথ্য তাদের জন্য নীতি প্রণয়নে সাহায্য করবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দেবাশীষ কুন্ডু বলেন, বস্তির বাইরে শহরে অন্যান্য যে দরিদ্র মানুষ আছে তাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীতে পারিবারিক সহিংসতার প্রভাব আরও নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করতে হবে। সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য এসব রিসার্চ উন্মুক্ত করতে হবে।

বার্ডের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে তৃণমূলের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। এই গবেষণার পরবর্তী ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের সঙ্গে শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ের মধ্যবর্তী সম্পর্ক পর্যালোচনা করা হলে আমরা আরও উপকৃত হব।